Rahul Olo's Archive ;)

জীবনের গল্প। লেখকঃ বিচিত্রা সেন।

জীবনের গল্প

বিচিত্রা সেন।
সহকারী অধ্যাপক।
বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজ, চট্টগ্রাম।


(১)

কলেজ থেকে বাড়ি ফিরেই মিতু কেমন একটা উৎসব উৎসব ভাব টের পেল। মা বাবার চোখে খুশির ঝিলিক। কয়েকজন আত্মীয়ও এসেছেন। মা একটু পরেই মিতুর কাছে এলেন। বললেন, “তোর বিয়ের কথাটা পাকা হয়ে গেলো।”
খুব একটা অবাক হলো না মিতু। বেশ কিছুদিন ধরে তার বিয়ের কথা চলছিল। আজ পাকা কথা হলো। এই পাত্র তার পিছু লেগেছে তিন বছর আগে থেকে। তখন সে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। মেয়ে খুব ছোট বলে তখন মা বাবা বিয়ে দেয় নি। এই বছর সে এসএসসি পাশ করলো। তার বাবা ভাবছেন এখনি মেয়েকে সৎ পাত্রে দান করতে হবে। যা দিনকাল পড়েছে! মেয়ে যদি আবার অসৎ সংগে পড়ে যায়।
মিতু ছোটবেলা থেকেই খুব শান্ত। মা বাবার খুব বাধ্য মেয়ে। সে জানে তার মা বাবা যা করছে তার ভালোর জন্যই করছে। ছেলে সরকারী অফিসার। পোস্টিং চট্টগ্রামের বাইরে। বিয়ের পর মিতুকে তার কাছে নিয়ে যাবে। সবকিছু মিতু আগেই জেনেছে। আজ পাকা কথা হয়েছে শুনে মনের ভেতর কেমন এক অজানা রোমাঞ্চ অনুভব করছিল। যদিও ছেলেটার সাথে তার এখনও কথা হয়নি, কিন্তু বাবা বলেছে ছেলে নাকি খুব ভাল। যাই হোক, হাতে একদম সময় নেই। আগামী পরশু তার এনগেজমেন্ট।
বেশ ভালোয় ভালোয় অনুষ্ঠান হয়ে গেলো। এর দুই দিন পরেই সে কলেজে গেলো। চোখে একরাশ লজ্জ্বা। কারন তাদের ক্লাসে এখনো কারো বিয়ে হয় নি। সেই প্রথম ওই জগতে পা রাখছে। কাউকে কিছু বললো না সে। কিন্তু বিপত্তিটা হল বাংলা ক্লাসে।
ম্যাডাম মিতুকে খুব স্নেহ করেন। রোল কল করেই জিজ্ঞেস করলেন, “এই কয়দিন আসনি কেন? মিতু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। ম্যাডাম দুষ্টুমি করে বললেন, “ওরে বাবা! এত লজ্জ্বা পাচ্ছো কেন? বিয়ে হয়ে গেছে নাকি?” মিতু চুপ করেই থাকল ম্যাডাম কথা না বাড়িয়ে ওকে বসতে বলে মূল পাঠে চলে গেলেন। ক্লাস শেষে ম্যাম যখন বেরিয়ে গেলেন তখন মিতু পেছন থেকে ডাক দিয়ে সালাম করে জানালো আসলেই তার বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেছে। ম্যাম তো ভীষণ অবাক। বললেন, “কি বলছো এইসব? তোমার তো এখনও বিয়ের বয়স হয় নি। ১৮ বছর পূর্ণ না হলে বিয়ে দেওয়া যায় না” মিতু খুব সরলভাবে বলল, “ম্যাম আমি কালো তো, তাই আমার বয়স হয়ে গেলে ভালো ছেলে পাওয়া যাবে না” ম্যামের আক্কেল গুড়ুম। বললেন, “কে শিখিয়েছে তোমাকে এসব বাজে কথা? মানুষের সৌন্দর্য থাকে তার ব্যক্তিত্বে। রঙ এর কথা এখানে আসবে কেন?” মিতু বলল, “ম্যাম উনি খুব ভালো মানুষ। আমার জন্য তিন বছর ধরে অপেক্ষা করছেন” ম্যাম তো আরো অবাক। এই মেয়ে বলে কী! তিন বছর আগে সে তো নেহাত শিশু ছিলকৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ছেলের বয়স কত?” মিতু নির্বিকারভাবে বলল, “৩২ বছর” ম্যাম বললেন, “তুমি এ বিয়েতে খুশি?” মিতু সলাজ হেসে বললো, “আমার মা বাবা বলেছেন, এত আগ্রহ করে ওরা যেহেতু আমায় নিচ্ছেন ওখানে আমি রাণীর মতো থাকব।”
মিষ্টি চেহারার এই সরল মেয়েটির কথা শুনে ম্যাম মন থেকে চাইলেন মেয়েটি যেন সুখী হয়। মা বাবার প্রতি যার এত অগাধ বিশ্বাস তার যেন কখনো স্বপ্ন ভঙ্গ না হয়।

(২)

কয়েকদিন ধরে মিতু ভীষণ অস্থিরতায় ভুগছে। কিছু ভাল লাগছে না তার। কলেজেও যেতে পারছে না। নয়ন অর্থাৎ তার হবু স্বামী বারণ করে দিয়েছে। মিতু খুব অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিল এর কারন।
নয়ন সোজা জানিয়ে দিয়েছে, যেসব কলেজে ছেলে মেয়ে এক সাথে পড়ে সেসব কলেজের মেয়েদের চরিত্র ঠিক থাকে না। ‘এম.কম’ পাশ একটা ছেলের মুখে এমন কথা শুনে মিতু বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকে মিতুর স্বভাব সবকিছু মায়ের সাথে শেয়ার করা। নয়নের এ কথা সে মাকে জানালো। মা প্রথমে খুব অবাক হয়ে গেলেও কিছুক্ষণ পরেই স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, এসব তোকে খেপাবার জন্য বলেছে” কিন্তু মিতু যখন জানালো কাল থেকে তার কলেজ যাওয়া বন্ধ তখন তিনি কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন।
রাতে খেতে বসে বাবার কানে তুললেন। বাবা তো বিশ্বাসই করলেন না। বললেন, “তোমার মেয়ে কি শুনতে কি শুনেছে। আমি এখনি ওর সাথে কথা বলছি। কিন্তু কথা বলার পরই বাবার মুখ ঘোর অন্ধকার। মিতুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ঠিক আছে। জামাই যখন বারণ করছে কয়েকদিন বাসায় থাক।
বাবার বাধ্য মেয়ে মিতুর বুক ফাটলেও মুখে কিছু বলল না। কিন্তু কলেজে না গিয়েও সে শান্তি পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরপরই নয়নের ফোন আসে। আর তাকে বিশদভাবে জানাতে হয় সে এখন কি করছে, এর আগে কি করছিল, ফোন রাখার পর কি করবে। প্রথম প্রথম মিতুর খুব ভাল লাগছিল নয়ন ওর এমন করে খোঁজ রাখছে দেখে। কিন্তু এখন নয়নের ফোন আসলেই তার মধ্যে চাপা আতংক তৈরী হয়। নয়নের কিছু কথায় এই আতংকটা তৈরী হচ্ছে।
মা ছাড়া আর তেমন কারও সাথে সে তার সব কথা শেয়ার করে না। কিন্তু নয়ন এমন কিছু কথা তার সাথে বলে যেগুলো সে মাকে বলতে পারছে না। আবার সহ্যও করতে পারছে না। সে বুঝতে পারছে না কাকে বললে সে কিছুটা হালকা হতে পারবেনয়ন চট্টগ্রামে না থাকলেও প্রতি মুহূর্তে তার উপর হুকুমদারী  করছে। বিয়ের এখনো এক মাস বাকী। কিন্তু বিয়ে মানে মিতু যেমনটি ভেবেছিল তেমনটি লাগছে না কেন তার? কেন দিন দিন সে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে? মাথা থেকে এইসব ভাবনা সে ঝেরে ফেলতে চায়। কিন্তু নয়নের ফোন আসার সাথে সাথেই আবার ভাবনাগুলো তাকে চেপে ধরে।
নয়ন কি সব যে তাকে বোঝাতে চায় সে কিছুই বুঝতে পারে না। তবে এতটুকু বুঝেছে যে নয়ন তাকে বিয়ে করছে তার মা বাবাকে খুশি করতে। আর তাই মিতুকে গ্রামের বাড়িতে ওর বাবা মার সাথেই থাকতে হবে। আর ওর বাবা মা চায় না বৌ বেশি লেখাপড়া করুক। তাই মিতুর উচিত নয়নের সন্তুষ্টির দিকে তাকানো। আবার বলে দিয়েছে, এসব কথা যেন বাবা মার সাথে আলোচনা না করে। কারন তাদের দাম্পত্য জীবনে কেউ নাক গলালে সে সেটা মেনে নিবে না। তখন মিতু সব হারাবে। 
মিতু বুঝতে পারে না সে এখন কী করবে। তারপর তার মনে হয় একবার কি বাংলা ম্যাডামকে গিয়ে সব খুলে বলবে? ম্যাডাম তাকে অনেক ভালবাসে সে সেটা বুঝতে পারে। তারপর সিদ্ধান্ত নেয়, হ্যাঁ ম্যাডামকেই সবকিছু বলবে সে।

(৩)

আজ অনেকদিন পর মিতু কলেজে এলো। বান্ধবীরা সব ঘিরে ধরলো তাকে।“কি রে তোর নাকি বিয়ে? আমরা দাওয়াত পাচ্ছি তো? মিতু হাসে, কিছু বলে না। সে খুঁজছে ম্যাডামকে। শেষ পর্যন্ত পেয়ে গেল তিন তলায়। তিনি তখন ক্লাস শেষ করে টিচার্স রুমে ফিরছিলেন।
মিতুকে দেখতে পেয়ে ম্যাডাম খুব অবাক হলেন। একি হাল হয়েছে মেয়েটার? ভীষণ ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে ওকে। চোখের দৃষ্টি কেমন যেন উদভ্রান্ত। খুব মায়া ভরা কণ্ঠে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে মিতু? অসুস্থ তুমি?” মিতু না সুচক মাথা নাড়লো।“তবে এমন দেখাচ্ছে কেন তোমায়? মিতু বললো, “ম্যাম, আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই। একটু সময় দেবেন?” মিতুর বলার মধ্যে এমন এক আকুতি ছিল যে তিনি মিতুকে নিয়ে পাশের একটা খালি ক্লাস রুমে গেলেন।
মিতু কেমন ইতস্তত করছে, কিভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। তিনি সস্নেহে বললেন, “আমি তোমার মায়ের মতো। বলো তুমি যা বলতে চাও।” মিতু যেন একটু সাহস পেল। বললো, “ম্যাম আমি এ বিয়েটা করতে চাচ্ছি না। কিন্তু কিভাবে এ কথা মা বাবাকে বলব বুঝতে পারছি না 
ম্যাডাম খুব অবাক হলেন। মিতুর মত শান্ত মেয়ে বিয়ে ভেঙ্গে দিতে চাচ্ছে? খুব নিরুত্তেজিত কণ্ঠে তিনি জানতে চাইলেন, “কেন?” মিতু বললো, “উনাকে আমার খুব ভয় লাগছে।” “ভয়?” ম্যাডামের কণ্ঠে রাজ্যের বিস্ময়! “হ্যাঁ ম্যাম, উনি ভালো মানুষ না।” বললো মিতু। “কেন? কি করেছে ও তোমার সাথে?” ম্যামের প্রশ্ন।
মিতু হঠাৎ করে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। বললো, “উনি খুব বিশ্রি বিশ্রি কথা বলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করেন এই পর্যন্ত আমি কয়জনের সাথে ডেটিং করেছি...।কয়টা ছেলে এই পর্যন্ত আমার হাত ধরেছে...। আমাদের বাসায় কোনো ইয়াং ছেলে আসে কিনা...। ম্যাম আমার খুব কান্না আসে এসব শুনলে। আরো বলে, আমি ছোট মেয়ে বিয়ে করছি ভালো মেয়ে পাওয়ার জন্য।  তাই যা কিছু করেছ আমায় বলে দাও। পরে কিন্তু আমার হাতে ধরা খেলে তখন ভয়াবহ পরিণতি হবে। বিশ্বাস করেন ম্যাম, আমি কোনদিন কোন ছেলের সাথে একা কথা পর্যন্ত বলিনি। কিন্তু উনি আমাকে প্রতিদিন এমনভাবে কয়েকবার জেরা করে যেন আমি খুব খারাপ একটা মেয়ে।  আমার খুব ভয় লাগছে ম্যাম।
ম্যাম বুঝতে পারলেন এই ছেলে মানসিকভাবে বিকৃত। তাই যে সময়টাকিশোরী একটা মেয়েকে রঙিন স্বপ্নে বিভোর করানোর কথা সে সময়টা সে বিকৃত চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়ে মিতুকে অসুস্থ করে তুলছে এবং একে বিয়ে করলে মিতুর জীবন বরবাদ হয়ে যাবে। তিনি মিতুর মাথায় হাত রেখে স্নেহ ভরা কণ্ঠে বললেন, “আসলেই তোমার বিয়েটা ভেঙ্গে দেওয়া উচিত। ওর সাথে তুমি সুখী হবে না।” মিতু বললো, “মাকে একটু বলেছিলাম। মা বললেন, ক্লাব ঠিক হয়ে গেছে, দাওয়াত হয়ে গেছে। এখন বিয়ে ভাঙলে সামাজিকভাবে খুব হেনস্থা হব।” ম্যাম বললেন, “তোমার জীবনের চেয়ে সমাজ বড়?” মিতু কিছু না বলে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। ম্যাম বললেন, “আমি যাবো তোমার মা বাবার কাছে?” মিতু আঁতকে উঠে বললো, “না না। আমার বাবা এতে খেপে যাবেন। আমাদের সংসারে আমার বাবার মুখের উপর কেউ কথা বলে না। থাক ম্যাম, আমি একবার বাবাকে বলবো। আর ২০ দিন বাকী আছে। দেখি কিছু করা যায় কিনা।”
ম্যাম তাকে বার বার করে বলে দিলেন যেন তাঁর সাহায্য লাগলে তাঁকে মিতু স্মরণ করে। কলেজ থেকে বেরিয়ে মিতুর অনেকটা হালকা লাগে। মনে হয় সে একা নয়, তার পাশে কেউ একজন আছেন। এর মধ্যে কিন্তু নয়নের অনেকবার ফোন এসেছে। ফোন নীরব ছিল বলে ম্যাম বুঝতে পারেন নি। এখন আর ওর তেমন ভয় করছে না। কিন্তু মিতু জানতো না ঠিক হয়ে যাওয়া বিয়ে ভাঙ্গার জন্য যতটুকু মনের জোর লাগে তা ওর মা বাবার ছিল না।

(৪)

কলেজ থেকে বাসায় ফিরতেই মা দৌঁড়ে আসলেনবললেন, “কি রে নয়নের ফোন ধরিস নি কেন? ও বাসায় ফোন করে জানতে চেয়েছিল তুই কোথায়? আমি বলেছি তুই কলেজে গেছিস বান্ধবীর একটা বই ফেরত দিতে।” বলতে বলতেই আবার নয়নের ফোন এলো মিতু রিসিভ করতেই প্রচণ্ড জেরার মুখে পড়ল। কিন্তু আজ আর মিতুর তেমন ভয় করছে না। কারন সে ঠিক করে ফেলেছে বিয়েটা সে করবে না। কতক্ষণ মিতুকে ধমকিয়ে নয়ন ফোন ছাড়লো। পরক্ষণেই মিতু মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, “মা আমার বিয়েটা ভেঙ্গে দাও।” “কি বাজে কথা বলছিস?” মায়ের বিরক্তিমাখা স্বর। মিতু কিছু বলার আগেই ঘরে ঢুকলেন মিতুর বাবা। কেমন ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। বললেন, “কিছু বুঝতে পারছি না। ছেলেপক্ষের দাবী দাওয়া তো শুধু বেড়েই চলেছে। আজ আবার বললো বর যাত্রী নাকি ৫০০ আসবে। কিভাবে যে এত কিছু সামলাবো?” একটা সুযোগ পেয়ে মিতু বললো, “বাবা এত খরচ করে আমার বিয়ে দেওয়ার দরকার নেই।” বাবা গম্ভীর স্বরে বললেন, “বড়দের কথার মধ্যে তুমি কথা বলবে না। এখান থেকে যাও।
মিতু চলে গেলে মা বললেন, “মেয়েটা মনে হয় এ বিয়েতে খুশী না।” বাবা বললেন, “খুশী না হলেও এ বিয়ে হবে। এ বাজারে সরকারী চাকরী পাওয়া ছেলে পাওয়াই যায় না। তার উপর তোমার মেয়ে কালো। একবার বিয়ে ভাঙলে এ জীবনে আর বিয়ে করা হবে না।” মা একটু চুপ থেকে আবার বললেন, “আসলে ছেলেটা যেন কেমন কেমন। আমার সাথে কথা বলতে চায় না। সেদিন মিতুকে বলেছিলাম এর কারন জিজ্ঞেস করতে। সে নাকি মিতুকে বলেছে আমার সাথে কথা বলতে তার অস্বস্তি লাগে।” বাবা অবাক হয়ে বললেন, “কেন?” মা বললেন, “আমার বলতে লজ্জ্বা লাগছে, তারপরও বলি। আমাকে নাকি তার শ্বাশুড়ী মনে হয় না।” বাবা বললেন, “আসলে ছেলের কথাবার্তা আমারও ভালো লাগে না। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। ভাগ্যের উপর সব ছেড়ে দিতে হবে। ওর কপালে যা আছে তা মেনে নিতে হবে।
পাশের ঘর থেকে মিতু সব শুনছিল। বাবার কথা শুনে সে ডুকরে কেঁদে উঠলো। সে শুনতে পেল মা বলছে, “বিয়ের পরে ও কষ্ট পেলে তুমি সহ্য করতে পারবে?” বাবা বললেন, “এ ধরণের ছেলেরা খুব সৎ হয়। দেখবে সে মিতুকে খুব সুখে রাখবে। তা ছাড়া সরকারী চাকরী, নিশ্চিত ভবিষ্যৎ।” মিতু অঝোরে কান্না করতে লাগল। সে বুঝে গেল বাবা কিছুতেই সিদ্ধান্ত পাল্টাবেন না। অবশেষে অনেক ঝগড়া বিবাদ, হুমকী ধামকীর মধ্য দিয়ে মিতুর বিয়েটা হয়ে গেল। মিতু পারলো না মা বাবার অবাধ্য হয়ে নিজের অধিকার আদায় করে নিতে।
বিয়ের দুই দিন আগে মা তাকে বলেছিলেন, যে সব ছেলে নাকি বউকে বেশি ভালবাসে তারা বউকে একটু চোখে চোখে রাখতে চায়। বিয়ের পরে একসাথে থাকলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এ কথা শুনে মিতু কিছুটা শান্ত হয়েছিল। ভেবেছিল,  হতে পারে হয়তো। মিতু ওর সংসারে চলে গেলে ওর এসব আচরণ পাল্টে যাবে। কিন্তু মিতু তখনো জানতো না তার জন্য কত বড় চমক অপেক্ষা করছে।

(৫)

শ্বশুর বাড়িতে পা রেখেই মিতু বুঝতে পারল ওদের পরিবারের সাথে এদের সবদিক দিয়েই বিস্তর ব্যবধান। সে এটাও বুঝতে পারলো যে, নয়নই ওদের পরিবারের প্রথম উচ্চশিক্ষিত। ওদের আত্মীয় স্বজনদের কথাবার্তা শুনে ওর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। খুবই অশিক্ষিত ওরা। যাই হোক মিতু ভাবলো, তাকে এদের নিয়েই থাকতে হবে। সুতরাং, মন খারাপ করলে চলবে না। কিন্তু একটা ব্যাপারে তার মন খুব খুঁতখুঁত করছে। তাকে যখন বরণ করে নেওয়া হচ্ছিল তখন একজন বয়স্কা মহিলা তার শ্বাশুড়ীকে বলছিল, “যে কালো বউ ঘরে আনলে, একে দিয়ে তোমার ছেলেকে ফেরাতে পারবে?” তার শ্বাশুড়ী তাড়াতাড়ি কথাটাকে এড়িয়ে গেলেন।
 এরপর থেকেই মিতুর মনটা ভার হয়ে আছে। কোথা থেকে নয়নকে ফেরাতে হবে তাকে? সারাদিন নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে গেল। এর মাঝে কিন্তু একটিবারের জন্যও নয়ন তার খবর নিল না। মিতুর চোখ বার বার তাকে খুঁজে বেড়াতে লাগলো। সন্ধ্যার পরে তার ঘরে এল নয়ন। বলল, “কেমন দেখলে তোমার শ্বশুর বাড়ি? এখানেই কিন্তু তোমাকে থাকতে হবে। আমি হয়তো মাসে কিংবা দুই মাসে একবার আসবো। আমার বাবা মা এর সেবা করাই তোমার প্রধান কাজ আমার এখন বিয়ে করার কোন ইচ্ছেই ছিল না। শুধু বাবা মার জন্য বিয়ে করেছি।” মিতু চুপ করে শুনে যাচ্ছিল,  কিছুই বলল না সে। তার মনে বার বার ঘুরপাক খাচ্ছিল তিনটা শব্দ ‘ওকে ফেরাতে হবে।
এরপর একটা একটা দিন যাচ্ছিল আর মিতু বুঝতে পারছিল তার কল্পনার সংসার জীবনের সাথে বাস্তবের সংসারের কোনো মিলই নেই। নয়ন বিয়ের পর ১৫ দিন ছিল বাড়িতে। এই সময়টা সে মিতুকে নিয়ে যত কথা বলেছে তার সবটুকুই ছিল মিতু যেন ঘরের কাজকর্ম তাড়াতাড়ি শিখে নেয়। লাকড়ীর চুলাতে রাঁধতে গিয়ে মিতু গলদঘর্ম হলেও নয়নের বিন্দুমাত্র সহানুভুতি পায়নি। বরং রান্নাঘর থেকে যখনি খেয়াল করেছে দেখা গেছে নয়ন চুটিয়ে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। মিতু রুমে আসলেই ব্যস্ততার ভান করে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। মিতুর কিছু বলার ছিল না। নয়ন এমন দূরত্ব রাখে তা অতিক্রম করে নয়নের কাছাকাছি যাওয়া মিতুর সম্ভব হয় না। আরেকটা ব্যাপার মিতু খেয়াল করেছে নয়নকে বাড়ির সবাই খুব ভয় পায়। ও চাওয়ার আগেই সবকিছু ওর জন্য তৈরী করে রাখা হয়। আরো একটা বিষয় মিতুর চোখে পড়েছে, আর তা হলো মিতুর শ্বাশুড়ী কিছুতেই মিতুকে একা রেখে কোথাও সরে না এবং কাউকে মিতুর কাছে আসতে দেয় না।
১৪ দিন হয়ে গেলো মিতুর বিয়ে হয়েছে। মা বাবা প্রতিদিন ফোন করে জানতে চান মিতু কেমন আছে। মিতু জানায় সে খুব ভাল আছে। আসলেই তো সে খারাপ নেই। যেসব প্রশ্ন তাকে পীড়া দিচ্ছে এসব কি মা বাবাকে বলবে সে! তাই সে ভালোই আছে বলে। কালকে নয়ন চলে যাবে তার কর্মক্ষেত্রে। মিতুকে কয়েক দিনের জন্য তার বাবার বাসায় যাবার অনুমতি দিয়েছে। তবে ৭ দিনের বেশি থাকতে পারবে না। মিতু সব গুছিয়ে নিচ্ছে। নয়ন রুমে নেই। ওর ফোন বেজেই চলেছে। ও কখনো ফোন রেখে কোথাও যায় না। বার বার বাজছে দেখে খুব জরুরী ফোন মনে করে মিতু রিসিভ করতে গেলো। হাতে নিয়ে দেখলো কেয়া নামের কেউ ফোন করেছে। ‘হ্যালো’ বলতেই ও পাশ থেকে ফোন কেটে দিল।
সাথে সাথেই রুমে ঢুকলো নয়ন। মিতু ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো, “কেয়া নামের একজন ফোন করেছে।” সাথে সাথে নয়ন ছোঁ মেরে ফোনটা কেড়ে নিল। তার চোখে আগুন জ্বলে উঠল। বলল, “আমার ফোন ধরার সাহস তোমাকে কে দিল?” মিতু বিস্ময়ে হতবাক।

(৬)

আজ দুই দিন হলো মিতু তার বাবার বাসায় এসেছে। বাবা মা তাকে এত আদর করছে মাঝে মাঝে তার খুব অচেনা মনে হচ্ছে উনাদেরকে। নয়ন প্রতিদিন কয়েকবার ফোন করছে। তার বিরহে নয়, সে যেন কোথাও না যায় তার তদারকী করার জন্য। কিছুই ভালো লাগছে না মিতুর। বার বার শুধু মনে পড়ছে নয়নের শেষ কথাগুলো। নয়ন বিন্দুমাত্র ভনিতা না করে তাকে বলে দিয়েছে, “দেখো মিতু, আমি তোমাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি আমি তোমাকে আমার জন্য বিয়ে করিনি। আমার মা বাবার সেবা করাই তোমার প্রধান কাজ। তা ছাড়া আমি ছোট এবং কালো মেয়ে বিয়ে করেছি শুধু একটা কারণে। বউ যেন কখনো আমার মুখের উপরে কথা না বলে। তাই কখনো আমার সাথে পাল্লা দিতে আসবে না। তাহলে কিন্ত সারা জীবন কাঁদতে হবে।” মিতু অপমানে কিছু বলতে পারে নি। তার মনে হয়েছে এসব কথার উত্তর দেওয়ার চেয়ে না দেওয়াই সম্মানজনক। কিন্তু একটা ব্যাপার সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না কেয়ার ফোন রিসিভ করাতে নয়ন ওর সাথে এমন দুর্ব্যবহার করল কেন? কে এই কেয়া? তাকে জানতে হবে।
কয়েকদিন পরেই মিতুকে ফিরে যেতে হলো শ্বশুর বাড়ি। ওখানে মিতুর দম বন্ধ হয়ে আসলেও করার কিছু নেই। মা বাবা বলে দিয়েছেন মেয়েদের আসল ঠিকানা ওটাই। তাই মিতু তার আসল ঠিকানাকে আপন করে নেওয়ার জন্য মনে প্রাণে চেষ্টা চালাতে লাগলো। মা বাবা ফোন করে প্রতিদিন, মিতু জানায় সে ভালো আছে। কি দরকার তার নকল ঠিকানার প্রতি মায়া বাড়িয়ে। কিন্তু একটা ব্যাপার মিতুকে খুব কষ্ট দেয়নয়ন তাকে একটা ফোন পর্যন্ত করে না এখন। খুব ইচ্ছে করে তার নয়নের কাছে ছুটে যেতে। তার সাথে বেড়াতে যেতে। কিন্তু তীব্র অভিমানে সেও ফোন করে না।
মিতু বুঝতে পারে তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ী তাকে ঠিক পছন্দ করছে না। আবার তা প্রকাশও করছে না। কোথায় যেন তাদের বাধা। তার শ্বাশুড়ী প্রায়ই তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, যেসব মেয়ে স্বামীকে বেঁধে রাখতে পারে না তাদের কপালে অনেক দুঃখ থাকে। মিতু বুঝতে পারে না স্বামীকে বাঁধার কথা কেন আসছে। তাহলে কি এখানে অন্য কোনো কাহিনী আছে? কি সেই কাহিনী?

(৭)

কয়দিন ধরে মিতুর শরীরটা একদম ভালো যাচ্ছে না। কিন্তু কাউকে বলতেও পারছে না। নয়নের উপর খুব অভিমান হয়। এতই ব্যস্ত সে? একটা ফোন করার প্রয়োজনও মনে করছে না। নিশ্চয় তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ীকে ফোন করে। উনারা অবশ্য এ ব্যাপারে কিছুই বলেন না। এসব ভাবতে ভাবতে ফোন এলো মায়ের। মিতুর কণ্ঠ শুনেই মা জিজ্ঞেস করলেন, “কি রে তোর শরীর খারাপ নাকি? স্বরটা এমন লাগছে কেন?মিতু বললো, “হ্যাঁ মা খুব খারাপ লাগছে।” তারপরের দিন মিতুকে অবাক করে দিয়ে ওর বাবা এসে উপস্থিত। মিতু তো বাবাকে দেখেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। মিতুর বাবা অনেক অনুরোধ করে মিতুকে দুই দিনের জন্য নিজের বাসায় নিয়ে আসলেন। পরদিন ওকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া হল। মিতুর মা ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন। মিতু মা হতে চলেছে। খুব খুশি উনারা। একটা বন্ধন তৈরী হচ্ছে। নয়নের মন এবার নরম হয়ে যাবে। কিন্তু শান্তি নেই মিতুর মনে। সে মা বাবাকে জানাতে চায় না নয়নের অবহেলার কথা। চলুক না যেমন চলছে।
পরদিন ফোন আসে নয়নের। মিতুর কাছে নয়, তার বাবার কাছে। বাবা শুভ সংবাদ জানায়। তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না নয়ন। শুধু বলে দেয় যেন কালকেই মিতুকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। মিতুর বাবা কিছু বলতে চায়, কিন্তু ফোন কেটে দেয় নয়ন। অগত্যা আবার ফিরে যেতে হয় মিতুকে তার আসল ঠিকানায়!

(৮)

এবার মিতুকে শ্বশুর বাড়িতে পাঠানোর পর থেকে মিতুর বাবা কেমন অস্থির হয়ে উঠেছে। বার বার মনে হচ্ছে মেয়েটা ভালো নেই। কি যেন লুকোচ্ছে উনাদের কাছ থেকে। এর মধ্যে নয়ন কিন্তু একবারের জন্যও আসে নি। এমন কি ব্যস্ততা ওর? মিতুর মায়ের সাথে পরামর্শ করেন সারারাত। তারপর একটা সিদ্ধান্ত নেন।
পরদিন আবার গিয়ে উপস্থিত হন মিতুর শ্বশুর বাড়িবলেন, মিতুর মা গুরুতর অসুস্থ। মিতুর শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর ভ্রুকুটিকে অগ্রাহ্য করে মিতুকে আবার নিয়ে আসেন নিজের কাছে। মিতুর কাছে এখন সব জায়গাই সমান। এখানে এসেও তার খুব একটা ভাল লাগে না। মন বার বার নয়নকে কাছে পেতে চায়। মেয়ের এমন উদাসীন অবস্থা সহ্য করতে পারেন না মিতুর বাবা। বার বার মনে হতে থাকে তিনি নিজ হাতে মেয়ের জীবন ধবংস করে দিয়েছেন। কতদিন তিনি মিতুর মুখে হাসি দেখেন নি। এমনভাবে চলতে থাকলে তো মেয়েটা মারা যাবে। না, আর না, এবার যা করতে হয় তিনিই করবেন।
একদিন সকালে মিতুকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, “নয়নের কাছে যাবি?” মিতু যেন কাঙাল হয়েই ছিল। বলল, “কে নিয়ে যাবে?” বাবা বললেন, “আমি।”
পরদিন মিতুকে নিয়ে বাবা ঠিক ঠিক নয়নের কর্মক্ষেত্রে রওয়ানা দিলেন। ওদের দেখে তো নয়ন ক্ষেপে আগুন। ওকে না জানিয়ে কেন এখানে আসা হলো? মিতুর বাবা কঠোরভাবে বললেন, “স্বামীর কাছে স্ত্রী আসবে। এতে তো আমি কোনো অপরাধ দেখছি না।” মিতুর বাবার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যে নয়ন আর কথা বাড়ালো না। ওদেরকে বাসায় নিয়ে গেলো। খুব পরিপাটি বাসা। বেশ গোছানো। নয়নের এমন গোছানো স্বভাবের কথা মিতুর জানা ছিল না। বেশ ভালো লাগলো তার। আজ খুব ভালো লাগছে মিতুর। এমন একটা দিনের প্রতীক্ষায় ছিল সে কতদিন ধরে।
পরদিন সকালে বাবা চলে যান। কিন্তু যাবার সময় মেয়ের চোখে মুখে দেখে যান এক অদ্ভুত প্রশান্তি। বাবা চলে যাবার পর মিতু ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে সারা ঘর। নয়ন অফিসে চলে গেছে। ওয়ারড্রোবের একটা ড্রয়ার খুলে সে চমকে ওঠে। মেয়েদের সাজ সজ্জ্বার সব জিনিস। এইসব কার? এমন সময় ঘরের দরজায় করাঘাত শুনে তাড়াতাড়ি ড্রয়ার বন্ধ করে দরজা খুলে দেয় মিতু। দেখে একজন মহিলা। উনি নিজেই পরিচয় দেন, “আমি পাশের বাসায় থাকি। আপনি?” মিতু জানায় নয়ন তার স্বামী। মহিলা খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন তার দিকে। তারপর কথা না বাড়িয়ে খুব দ্রুত চলে যান। মিতুর কাছে সবকিছু খুব রহস্যময় মনে হয়। রাতে নয়ন ফিরলে নয়নের কাছে গিয়ে বসে। সে বুঝতে পারে নয়ন বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু মিতু বসেই থাকে। নয়ন ল্যাপটপে কাজ করছে খুব মনোযোগ দিয়ে। মিতুর ঝিমুনি আসে, এবং এক সময় নিজের অজান্তে ঘুমিয়েই পড়ে।
হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসে মিতু। দেখে পাশে নয়ন নেই। পা টিপে টিপে সে পাশের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। ওই রুম থেকে নয়নের কথা শোনা যাচ্ছে। মিতু সব শুনতে পায়.... সব স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে.... পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে মিতুর। নয়ন তখন কেয়াকে আশ্বস্ত করে বলছে, “তুমি রাগ করো না। আমাকে কয়েক দিন সময় দাও। যেমন করে পারি আমি ওকে তাড়াবো। আমরা যেমন আছি তেমনি থাকবো। তুমিই আমার একমাত্র স্ত্রী। এই বাসা তোমার। তোমারই থাকবে। প্লিজ, প্লীজ, রাগ করো না।” অন্ধকার হয়ে আসে মিতুর চারপাশ। কিছু ভাবতে পারছে না সে। এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা কি করে সে মেনে নেবে? কী হবে তার সন্তানের? কী দোষ করেছিল সে? কেন এমন করে তাকে নিয়ে খেললো নয়ন? কার কাছে জবাব চাইবে সে?
 
সমাপ্ত।

Search anything from this blog ;)