Rahul Olo's Archive ;)

দহন। লেখকঃ বিচিত্রা সেন।

দহন

বিচিত্রা সেন।

সহকারী অধ্যাপক।

বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজ, চট্টগ্রাম।

(১)

একবার আমি মিতুর গল্প বলেছিলাম। যদিও ওটা গল্প ছিল না, ছিল সত্যি কাহিনী। এটাও আরেক মিতুর গল্প। যদিও বাস্তবে মেয়েটির নাম মিতু নয়। মিতু এখন আমার কাছে একটা প্রতীকী নাম।
মিতু খুব সাধারণ একটা মেয়ে। কিন্তু ওর দুর্ভাগ্য এই যে কারো কারো চোখে সে অসাধারণ হয়ে উঠলো। এখান থেকেই তার জীবনের জটিলতা শুরু। কলেজ থেকে ফিরছিল একদিন সে। গলির মুখে দাঁড়ানো কয়েকটা ছেলে। পাশ কাটিয়ে যেতেই তীব্র শীসের আওয়াজ। গা ঘিনঘিন করে ওঠে মিতুর। তাকে শীস দিয়ে ডাকছে? অপমানে নিজেকে খুব ছোট মনে হয়।
কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করে না। কারণ সে ছেলেগুলোকে চেনে। প্রভাবশালী পরিবারের ছেলে। বলে লাভ নেই, ওরা শোধরাবে না।

বাসায় ঢুকে মাকে বলে সে পুরো ঘটনাটা। মায়ের সাথে মিতুর ভীষণ ভাব। মা তার খুব ভালো বন্ধু। মা শুনে বলেন, "পাত্তা দিস না ওদের। কিছু বলিস না। ওদের দিকে না তাকালে ওরা কিছু বলবে না।" মিতু ভাবে হয়তো মায়ের কথাই ঠিক। কিন্তু পরদিন আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এরপরের দিন আবারও।
মিতুর কাছে বাসায় ফেরাটা এখন আতংকের। কলেজে যাওয়ার সময় ওরা থাকে না। কিন্তু আসার সময় দল বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রায় এক সপ্তাহ সহ্য করার পর মিতু একদিন মাকে বললো সে আর কলেজে যাবে না। মায়ের কোনো কথা সে শুনতে নারাজ। মা বুঝতে পারলেন ঘটনা হয়তো খারাপের দিকে মোড় নিবে। তাই তিনি ছেলেগুলোকে বাসায় ডাকালেন। তিনি ভেবেছিলেন হয়তো ছেলেরা এতে ভয় পেয়ে যাবে। বাসায় তো আসবেও না, এরপর থেকে রাস্তায়ও দাঁড়াবে না। কিন্তু তাঁকে অবাক করে দিয়ে দুটো ছেলে বিকেলে তাঁর বাসায় এসে হাজির।

(২)

মিতুর মা ছেলেগুলোকে ভালো করে দেখলেন। একটা ছেলে তাঁর পরিচিত। ওদের পরিবারের সাথে একসময় উনাদের খুব আসা যাওয়া ছিল। মিতুর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে কিছুটা কম। আর একটা ছেলেকে তিনি চিনতে পারলেন না। চেনা ছেলেটাকে তিনি বললেন, "তোমাদের কেন ডেকেছি জানো?" ছেলে দুটো খুব অবাক হয়ে বললো, "না তো আন্টি।" মিতুর মা বুঝলেন এদের সাথে কৌশলে এগুতে হবে। তিনি বললেন, "মিতু বললো ও কলেজ থেকে আসার সময় নাকি কয়েকটা ছেলে ওকে খুব ডিস্টার্ব করে। তোমরা কি ওদের চেনো?" ওদের মধ্যে চেনা ছেলেটির নাম নিলয়। সে বললো, "কার এত সাহস? মিতুর সাথে এমন করে? আপনি একটুও ভাববেন না আন্টি আমরা এটা দেখবো। কাল থেকে কেউ আর ওর দিকে চোখ তুলে তাকাবে না।" মিতু অন্য রুম থেকে সব শুনতে পাচ্ছিলো। এ কথা শুনে সে কৌতূহলী হয়ে পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখলো কে তার নিরাপত্তার ভার নিচ্ছে। উঁকি দিয়ে তো তার চোখ ছানাবড়া। যে ছেলেটি তাকে দেখলে শীস দেয় সেই এ কথা বলেছে। একবার ভাবলো বের হয়ে সে ছেলেটির মুখোশ খুলে দিবে। কিন্তু পরমুহূর্তে মায়ের একটা সাবধানবাণী তার মনে পড়লো। এসব ছেলেকে এড়িয়ে যেতে হয়। এদের সাথে মুখোমুখি না হওয়াই ভালো। একটু পর নিলয়রা চলে গেলো। যাওয়ার সময় বার বার করে বলে গেলো মিতু যেন কাল থেকে অবশ্যই কলেজে যায়।
পরদিন মিতু কলেজে গেলো। এবং কলেজ থেকে আসার সময় খেয়াল করলো ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে থাকলেও ওকে দেখে কোনো খারাপ আচরণ করলো না। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন মিতু। বাসায় এসে মাকে জড়িয়ে ধরে কি খুশী তার। "জানো মা, ওরা ভদ্র হয়ে গেছে। আমাকে কিছুই বলেনি আজকে।" মাও একটা তৃপ্তির হাসি দিলেন। আজ মিতু ছোট ভাইটির সাথে অনেক দুষ্টুমী করলো। তার মনটা আজ ভীষণ ফুরফুরে।
সন্ধ্যার পর দুই ভাই বোন মিলে যখন পড়ছিলো তখন কলিংবেলের শব্দ। মিতু ভাবলো নিশ্চয় ওর মামা এসেছে। দৌঁড়ে গিয়েই সে দরজা খুললো মুহূর্তেই তার মুখ ফ্যাকাসে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিলয়, পেছনে তার মা। এক ছুটে মিতু ভেতরে চলে যায়। ওর ফ্যাকাসে মুখ দেখে ওর মা ও ভাই ছুটে আসে কে এসেছে দেখতে! নিলয় আর ওর মাকে দেখে মিতুর মা বিব্রত হয়ে পড়েন। অপ্রস্তুত হাসি হেসে ওদের ভেতরে এনে বসান। অনেক বছর পর উনি এসেছেন। তাই আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত হন। নিলয়ের বাবা খুব প্রভাবশালী এলাকায়। তাই নিলয়ের মায়ের অনেক দাপট। মিতুর বাবা মারা যাওয়াতে তাদের আগের সেই অবস্থান নেই। একথা সেকথা বলার পর নিলয়ের মা মিতুকে ডাকতে বলেন। মিতুর মা বলেন, "মেয়েটা লাজুক। তেমন একটা মিশুক নয়।" বলেন না যে নিলয়ের ভয়ে মিতু আসছে না এ রুমে। তখনই নিলয়ের মা কথাটা বলেন। বেশ আত্মপ্রত্যয়ী কণ্ঠে জানান নিলয় মিতুকে খুব পছন্দ করেছে। তাই মিতুকে তিনি ছেলের বৌ করতে চান। মিতুর মা জানতে চান নিলয় কী করে? নিলয়ের মা অহংকারী স্বরে বলে, "এখন কী করবে? ও তো পড়ছে ভার্সিটিতে। ওর বাবার যা আছে তা দিয়ে তিন পুরুষ খেলেও শেষ হবে না।" প্রমাদ গুনেন মিতুর মা। এতো কাছের মানুষ ওরা। ওদের সরাসরি নাও বলা যায় না। তাই বলেন, "মেয়ে তো এখনো ছোট। এইচ এস সি পাশ করুক। আরও বড় হোক তারপর না হয় এসব নিয়ে ভাবা যাবে।" নিলয়ের মা সেটাতে তেমন আপত্তি না করলেও কঠিন হয়ে ওঠে নিলয়ের মুখ।

(৩)

নিলয়রা চলে যাওয়ার আগে মিতুকে একবার ওদের সামনে আনা হলো। বলতে গেলে জোর করেই। নিলয়ের মা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মিতুকে দেখলেন। মিতু মাথা নিচু করে বসে রইলো। নিলয়ের মা কোনো মন্তব্য করলেন না। একটু পর উনারা চলে গেলে মিতু মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, "মা আমি ওকে বিয়ে করবো না। ওকে আমার খুব ভয় লাগে।"  মিতুর মা চিন্তিত মুখে বললেন, "দেখি, কী করা যায়!" এর মধ্যে মিতুর কলেজে আসার পথে আর কিছু ঘটলো না। কিন্তু ঘটনা ঘটলো কয়েকদিন পর। পাড়ার একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মিতুর গান গাইবার কথা। অনুষ্ঠানে গিয়েই মিতু দেখতে পেলো নিলয় তার দলবল নিয়ে সামনের সারিতে বসে আছে। অজানা আশংকায় মিতুর বুক কেঁপে উঠলো। উপস্থাপক যেইমাত্র মিতুর নাম ঘোষণা করলো নিলয়ের দল এমন বিশ্রীভাবে সিটি বাজাতে লাগলো যে অনুষ্ঠানে একটা হট্টগোল শুরু হয়ে গেলো। মিতু ভয় পেয়ে আয়োজকদের জানালো সে গান করবে না। আয়োজকরা তাকে শান্ত থাকতে বলে কয়েকজনকে পাঠালো নিলয়দের শান্ত করার জন্য। ওরা কি বললো কে জানে! দেখা গেলো নিলয় তার দল নিয়ে বের হয়ে গেলো। মিতু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মঞ্চে উঠে গান গাইলো। আয়োজকদের মধ্যে একজন এসে তাকে বাসায় পৌঁছে দিলো। কিন্তু পরদিন কলেজ থেকে আসার সময় সে শুনতে পেলো নিলয়ের এক বন্ধু তাকে শুনিয়ে বলছে, "অপুর অবস্থা তো বেশ খারাপ। একটা হাত, একটা পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আর কেউ যদি এমন করে কাউকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেয় তবে ওরও একই পরিণতি হবে।"
চকিতে মিতু একবার তাকালো নিলয়ের দিকে। ও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিতুর দিকে। চোখ জোড়া জ্বলছে হিংস্র নেকড়ের মতো। মিতুর পা যেন চলছে না। কাল সে একা আসতে ভয় পাচ্ছিলো বলে অপু তাকে রাতে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিল। আর তার মাশুল তাকে এভাবে দিতে হলো! নিলয়ের প্রতি তীব্র ঘৃণা এলো তার। কোন অধিকারে সে এমন করছে। কিন্তু নিলয়কে কিছু বলার সাহস তার নেই। একে তো নিলয় তার পাঁচ বছরের সিনিয়র। তার উপর নিলয় ভীষণ বেপরোয়া। বাসায় এসে সে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। কাউকে কিছু বললো না।
পাড়ায় একটা গুঞ্জন চলছে। সবাই জেনে গেছে মিতুর কারণেই অপু মার খেয়েছে। কিন্তু নিলয়ের বেপরোয়া আচরণের জন্য তাকে কেউ কিছু বলে না। এর কয়েকদিন পর মিতু জানতে পারলো নিলয় নাকি ওর চেয়ে সিনিয়র এক ছেলেকে বেদম পিটিয়েছে। ওর অপরাধ সে নাকি বলেছে এ পাড়ার সেরা সুন্দরী মিতু। ওকে একবার না দেখলে রাতে ওর ঘুম হয় না। লজ্জায় অপমানে মিতুর ইচ্ছে করছিলো মরে যেতে। সে বুঝতে পারলো নিলয় ইচ্ছে করে এমন করছে মিতুকে হেনস্থা করার জন্য। এমন করে করে মিতুর এইচ এস সি পরীক্ষা চলে এলো। পরীক্ষা ভালো হচ্ছিলো, কিন্তু উৎপাত শুরু করলো নিলয়। প্রতিদিন ওর পিছু পিছু বাইক নিয়ে সেন্টারে যায়, আবার আসার সময়ও পিছু পিছু আসে। ওর ভয়ে মিতু কোনো বন্ধুর সাথে কথা বলে না। কারণ সে জানে যেই ওর সাথে কথা বলবে তাকেই মার খেতে হবে। নিলয় ওর সাথে কথা বলে না, কিন্তু সারাক্ষণ ওর কোনো না কোনো বন্ধু মিতুর উপর নজর রাখছে।
পরীক্ষা শেষ হয়, একসময় রেজাল্টও হয়। ভালো রেজাল্ট করে মিতু এবার ভার্সিটিতে ভর্তির পালা। ওদের দূরসম্পর্কের এক ভাই ওর সবকিছু করে দেয়। খুব খাটে মিতু ভার্সিটিতে টেকার জন্য এবং টিকেও যায়। এর মধ্যে নিলয় তেমন উৎপাত করেনি। কিন্তু প্রথম দিন ক্লাস করতে যাওয়ার সময় বাধলো বিপত্তি। সেই ভাইয়ের সাথে সে সবেমাত্র শাটল ট্রেনে উঠে বসেছে, অমনি একটা ছেলে এসে ওর সেই ভাইকে ডেকে নিচে নিয়ে গেলো আর সাথে সাথেই ওর পাশে এসে বসলো নিলয়। মিতু বাকরুদ্ধ। কিছুই চেনে না সে। উঠেও যেতে পারছে না। শুধু উশখুশ করছে সেই ভাই কখন ফিরে আসে তার জন্য। কিন্তু ট্রেন ছেড়ে দিলো, ও আর আসলো না।

নিলয় বললো, "ও আজ থেকে আর তোমার সাথে কথা বলবে না। এমন কি তোমার ধারে কাছেও আসবে না।" মিতুর ইচ্ছে হলো ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিতে। কিন্তু মা আর ছোট ভাইটির কথা ভেবে সে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললোকিন্তু তার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন যে নিলয় তছনছ করে দেবে এটা ভেবেই অবসাদে তার মন ভেঙে পড়লো।

(৪)

মিতু আস্তে আস্তে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। পুরনো বন্ধুদের সাথে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে নতুন বন্ধু। শাটল ট্রেন, মউর দোয়ান, কাটা পাহাড়, চাকসু ক্যাফেটেরিয়া সব মিলিয়ে বেশ আনন্দময় মনে হচ্ছে তার ভার্সিটি লাইফ। একদিন আর্টস ফ্যাকাল্টির সামনের দোকানে বসে বন্ধুদের সাথে চা খাচ্ছিলো হঠাৎ একটা পিচ্চি টোকাই এসে বললো, "মামী.. আফনারে মামা ডাকে" শুনেই চমকে উঠলো মিতু। চকিতে পাশের দোকানে তাকিয়ে দেখলো নিলয় চোখের ইশারায় ওকে ডাকছে। অজানা আশংকায় কেঁপে উঠলো মিতুর মন। ওর বন্ধুরাও খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নিলয়ের দিকে। ওরা বুঝে উঠতে পারছে না মিতুকে ছেলেটা মামী ডাকলো কেন। মিতু চোখ ফিরিয়ে নিল। যাবে না সে নিলয়ের কাছে। এতো লোকের সামনে নিশ্চয় নিলয় কিছু করতে পারবে না। কিন্তু মিতুর ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে নিলয় উঠে আসে। মিতুর পাশে দাঁড়িয়ে বলে, "এখানে এতো আড্ডা কিসের? ক্লাস নেই? ক্লাস না থাকলে বাসায় চলো" মিতুর বন্ধুরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ওরা বুঝে উঠতে পারছে না এই সিনিয়র ভাইয়াটা মিতুর কী হয়? হতচকিত মিতু প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও পরে সাহস সঞ্চয় করে বলে, "আমি এখন কোথাও যাবো না।" মুহূর্তেই আগুন জ্বলে ওঠে নিলয়ের চোখে। যে কাজটা এতোদিন করেনি সেটাই করে বসে। মিতুর হাত টান দিয়ে বলে, "ওঠো বলছি।" অপমানে মিতুর মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। সে উঠে দাঁড়ায়, কারণ সে জানে নিলয়ের মেজাজ সম্পর্কে। সে উছিলা খুঁজছে মিতুর বন্ধুদের মারার জন্য। আশেপাশের সবাই তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। কেউ বুঝতে পারছে না কী ঘটতে চলেছে। মিতু উঠে দাঁড়াতেই নিলয় ওর হাত ছেড়ে দিয়েছিলো। মিতু হনহন করে ফ্যাকাল্টির দিকে পা বাড়ায়। মনে মনে ভাবে আজই এর একটা বিহিত করতে হবে। বন্ধুদের মধ্যে আজ মিতুকে ঘিরে বিস্তর আলোচনা হয়। সবার কৌতূহল কে এই যুবক? ওর সাথে মিতুর কী সম্পর্ক? মিতু কি তবে বিবাহিত? মিতু তাহলে মায়ের সাথে থাকে কেন?
প্রতিদিনের মতো আজও মিতু খেয়াল করলো নিলয় ওর কম্পার্টমেন্টেই উঠেছে। যদিও পাশে বসেনি। কারণ পাশে ওর দুই বান্ধবী বসা। বাসায় ফিরে মিতু না খেয়েই শুয়ে পড়লো। মা খুব অবাক হলেন, কারণ তিনি জানেন মিতু ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না। মাথার কাছে বসে তিনি জানতে চাইলেন নতুন কিছু ঘটেছে কিনা। মিতু কখনোই মায়ের কাছে কিছু লুকায় না। আজও লুকালো না। সব শুনে তিনি বললেন, "দেখি, আজ ওদের বাসায় যাবো। ওর বাবাকে সব জানাবো। ওর বিয়ে করার ইচ্ছে থাকলে অপেক্ষা করুক। কিন্তু এমনভাবে সবার সামনে সে তোকে নাজেহাল করবে কেন?" মিতু বললো, "মা, আমি ওকে কখনোই বিয়ে করবো না। ওকে আমার খুব ভয় লাগে। একটুও ভালো লাগে না। ওকে আমার পছন্দ না।"

মিতুর মাকে খুব চিন্তিত মনে হলো। কারণ তিনি পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি বুঝতে পারছেন না যে তিনি কি আত্মীয় স্বজনকে জানাবেন, নাকি আইনের আশ্রয় নিবেন, নাকি নিলয়ের পরিবারের সাথে কথা বলে আপোষের মাধ্যমে এর সুরাহা করবেন। দুই দিন দুই রাত ভেবে শেষ পর্যন্ত তিনি নিলয়দের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলেন।

(৫)

নিলয়ের বাবা মা মিতুর মাকে দেখে একটু অবাক হলেন। তাহলে কি উনি বিয়ের সম্বন্ধ পাকা করতে এসেছেন। যদিও ছেলে এখনো পাশ করে বেরোয়নি, তবুও বিয়েতে তাঁরা আপত্তি করবেন না। কারণ নিলয়ের নামে প্রতিদিনই কোনো না কোনো অভিযোগ আসবেই। ছেলেটা দিনকে দিন বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছে। মিতুকে পেয়ে যদি সে সংসারী হয় তবে তো ভালোই। তাছাড়া মিতুর বাবা যখন বেঁচে ছিলেন দুই পরিবারের মধ্যে বেশ আসা যাওয়াও ছিল। মিতুদের পারিবারিক ঐতিহ্য আছে। তাই মিতুর মাকে তাঁরা সাদরেই বরণ করেন। একথা সেকথা বলার পর মিতুর মা আসল কথা পাড়েন। জানান নিলয় খুব বিরক্ত করছে মিতুকে। নিলয়ের বিয়ে করার ইচ্ছে থাকলে আগে পাশ করে বের হোক, কিছু একটা করুক। মুহূর্তেই পাল্টে যায় ঘরের পরিবেশ। মুখ গম্ভীর করে কাজ আছে বলে ভেতরে চলে যান নিলয়ের বাবা। নিলয়ের মাও গম্ভীর হয়ে যান। এরপর কথা আর বেশিদূর এগুতে পারে না। দুই পক্ষের মনে কেমন একটা সংকোচ দানা বাঁধে। মিতুর মা বলেন, "আজ তাহলে আসি। নিলয়কে একটু বুঝিয়ে বলবেন মেয়েটা ওকে ভয় পায়। ও যেন মিতুকে ভয় না দেখায়।" নিলয়ের মা খুব অবাক হয়ে বলেন, "এই প্রথম শুনলাম আমার নিলয়কে কেউ ভয় পায়! ওতো খুবই শান্ত একটা ছেলে। ওকে ভয় পাবে কেন? মিতুর কোনো দুর্বলতা নেই তো যেটা নিলয় জানে!" মিতুর মা বোঝেন নিলয়ের প্রশ্রয়দাত্রী তার মা। আর কথা না বাড়িয়ে তিনি বেরিয়ে আসেন। বাসায় ফিরে উৎকণ্ঠিত মিতুকে তিনি সান্ত্বনা দেন আর এমন হবে না বলে। তবে নিজের মনের শান্তি তিনি আর ফিরিয়ে আনতে পারেন না। কেমন একটা অমঙ্গল আশংকা তাঁকে অস্থির করে তোলে।
এরপর দুইদিন নিলয়কে ক্যাম্পাসে দেখা যায় না। তৃতীয় দিন বিকেলে মিতুদের বাসায় আসে অল্পবয়সী দুটো ছেলে। মিতু ওদের চেনে না, মিতুর মা এবং ভাইও চিনতে পারে না। কিন্তু ওরা বলে নিলয় ওদের পাঠিয়েছে। মিতুর সাথে একটু কথা বলেই চলে যাবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কৌতূহলের বশে ওদের ঘরে ঢুকায় মিতু। মিতুর মা ও ভাই পাশের রুমে অপেক্ষা করে। ছেলে দুটো খুব ভদ্রভাবে মিতুকে বলে, "নিলয় ভাই আপনার জন্য একটা গিফট পাঠিয়েছে। এই নিন।" বলে মিতুর সামনে ওরা একটা প্যাকেট রাখে। মিতু বলে, "ওকে বলে দিও আমি কোনো গিফট নিবো না। এটা তোমরা নিয়ে যাও।" ছেলেগুলো মিতুর ছোট হবে। তাই সে ওদের তুমি করে বলে। একটা ছেলে মুচকী হেসে বলে, "আচ্ছা, না নিলে না নিবেন। একবার দেখেন গিফটটা কী?" মিতু বলে, "শুধু শুধু আমি এটা দেখবো কেন! আমি তো এটা নিচ্ছি না।" তখন অন্য ছেলেটি বলে, "আপনি নিজে না দেখলে তো আমাদেরই দেখাতে হয়।" বলে সে প্যাকেটটা ছিঁড়ে ফেলে

এরপরের মুহূর্তটার জন্য মিতু মোটেও প্রস্তুত ছিল না। আতংকে তার মুখ থেকে একটা অস্ফুট শব্দ বের হয়। তার সামনে ছেঁড়া প্যাকেটের ভেতর একটা পিস্তল। একটা ছেলে সেটা হাতে নিয়ে বলে, "নিলয় ভাই বলেছে বেশি ন্যাকামো করলে এর একটা গুলি আপনার মায়ের বুকে, আরেকটা গুলি আপনার আদরের ছোট ভাইয়ের বুকে জায়গা নেবে।" একটা শব্দও আর বের হয় না মিতুর মুখ থেকে। সে বুঝতে পারে নিলয়ের হাত থেকে তার মুক্তি নেই। ছেলে দুটো হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, "শুনেন, ভালোয় ভালোয় সামাজিক বিয়েতে রাজী হয়ে যান। নাহলে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করানো হবে। সেটা কারো জন্যই সম্মানজনক হবে না।" বলেই চলে যায়। দরজার আওয়াজ শুনে মিতুর মা ছুটে এসে বলেন, "ওরা কই?" মিতু কিছু বলে না। ওর মাথা শূন্য হয়ে গেছে। চিন্তাশক্তি কাজ করছে না এই মুহূর্তে। মা ওর শূন্য দৃষ্টি দেখে বার বার জানতে চান কী হয়েছে। কিন্তু মিতুর আর ইচ্ছা করে না মাকে কিছু জানাতে। তার বার বার কানে বাজতে থাকে "বেশি যদি ন্যাকামো করেন তবে......"
কী করবে সে? বিয়েতে রাজী হয়ে যাবে? তাহলে তো অন্তত এই মানসিক চাপ থেকে বাঁচবে। কিন্তু ওতো এমন ছেলেকে কখনো স্বামী হিসেবে চায়নি। সে কি পারবে নিলয়কে মেনে নিতে? মাথাটা একদম কাজ করছে না। চুপচাপ শুয়ে থাকে মিতু। ভেঙে যাচ্ছে তার স্বপ্নসৌধ। তলিয়ে যাচ্ছে সে সীমাহীন এক গহ্বরে!

(৬)

কয়েকদিন মিতু আর ক্যাম্পাসে গেলো না। ভয়, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা সব মিলিয়ে তাকে ভীষণভাবে বিষণ্ণ করে তুলেছে। মা বার বার জিজ্ঞেস করেও কিছু বের করতে পারলেন না মিতুর মুখ থেকে। শুধু ওর ছোট ভাইটি মাঠে খেলতে যেতে চাইলে ও প্রাণপণে বাধা দিতে লাগলো। এ নিয়ে কয়েকবার ওর মা ভাইয়ের সাথে ঝগড়াও লেগেছে। কয়েকদিন পর ওর বান্ধবীরা বাসায় এসে উপস্থিত। সবার একই প্রশ্ন। কেন সে ক্যাম্পাসে যাচ্ছে না? অসুখ তো করেনি। তাহলে কিসের বাধা। মিতু ওদের জানালো কাল থেকে সে যাবে। পরদিন শাটল ট্রেন থেকে নেমে যখন বান্ধবীরা সহ ওরা মউর দোয়ান এর সামনে দিয়ে যাচ্ছে তখনই একটা পিচ্চি এসে ডাক দিলো, "মামী আফনারে মামায় ডাকে।" বুকটা কেঁপে ওঠে মিতুর। যা ভেবেছিল তা। নিলয় তাকে পাহাড়া দিয়ে বসেছিল। আজ আসার সাথে সাথেই ধরেছে। মিতুর বিবর্ণ চেহারা দেখে বান্ধবীরা ঘটনা কিছু আঁচ করতে পারে। ওরা বলে, "সত্যি করে বল তো উনার সাথে তোর কী সম্পর্ক? আর উনাকে দেখলে তুই এতো ভয় পাস কেন?"
মিতু চাপা স্বরে বলে, "সন্ত্রাসী একটা। আমার পিছু লেগেছে ২/৩ বছর ধরে। একদম সহ্য করতে পারি না আমি।" বান্ধবীরা বলে, "সেটা আমাদের আগে বলবি না? চল তো দেখি! কি বলে শুনি।" মিতু ওদের নিয়ে এগিয়ে যায়। ওদের সাহস দেখে ওরও একটু একটু সাহস লাগছে। কিন্তু নিলয়ের সামনে যেতেই ও বলে উঠল, "তোমরা এখানে এসেছো কেন?  যাও এখান থেকে। আমি মিতুর সাথে একা কথা বলবো।"
"নিলয়ের বন্ধুরা সব বিশ্রীভাবে হো হো করে হেসে উঠলো। বিদ্রূপ করে বললো, "সখী পরিবেষ্টিত নায়িকা।" ওর বান্ধবীরা ক্ষেপে গিয়ে বললো, "চল মিতু, এখানে তোকে থাকতে হবে না।" মিতু যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হুঙ্কার দিয়ে উঠলো নিলয়।" এখান থেকে এক পাও নড়বে না। যদি নড়ো খুব বিশ্রী কেলেঙ্কারী ঘটবে কিন্তু আজ।" মিতু অসহায়ভাবে তাকালো বান্ধবীদের দিকে। বান্ধবীরাও নিলয়ের উগ্ররূপ দেখে খানিকটা ভয় পেয়ে গেছে। ওদের মধ্যে একজন শান্তভাবে বললো, "ঠিক আছে মিতু, তুই কথা বলে আয়। আমরা পাশের দোকানে আছি।" বলেই ওরা সত্যি সত্যি মিতুকে রেখে পাশের দোকানে চলে গেলো। নিলয় হুকুমের স্বরে বললো, "বসো। জরুরী কথা আছে।" মিতু মাথা নিচু করে নিলয়ের বিপরীতের টুলে বসলো। নিলয়ের বন্ধুরা খুব মজা পাচ্ছিলো। মিতু বসার সাথে সাথে চিৎকার করে অর্ডার দিলো, "ওই মামা.. আমাগো ভাবীরে দুইটা সিঙ্গারা আর এক কাপ চা দাও।" অপমানে মিতুর দুচোখ ছাপিয়ে জল আসছিলো। ঠোঁট কামড়িয়ে সে তা চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলো।
নিলয় বললো, "দেখো মিতু, তোমাকে অনেক সময় দেওয়া হয়েছে। ভেবেছিলাম তুমি ভালোবেসে আমাকে গ্রহণ করে নেবে। কিন্তু ইদানিং দেখছি তুমি আর তোমার মা খুব সাহসী হয়ে উঠছো। তাই আমি ভেবেছি এই মাসেই আমি বিয়েটা করে ফেলবো। তোমার মতের জন্য যদি আমি অপেক্ষা করি তবে আমার আর তোমাকে বিয়ে করা হবে না।"
আর পারলো না মিতু, অঝোরে ঝরছে তার দুচোখে জল। নিলয় দেখলো মিতু মাথা নিচু করে নীরবে কাঁদছে। কিন্তু এতে দমার পাত্র সে নয়। তাই ঠাট্টা করে বললো, "বিয়ের কথায় সব মেয়েই কাঁদে। একটা ঘর ছেড়ে আরেকটা ঘরে যাবে, খারাপ লাগাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে তো তুমি বিয়ে না করে থাকতে পারবে না। আর বিয়ে যখন করতেই হবে সময় নষ্ট না করে আমাকেই করে ফেলো।"

নিলয়ের কথা বলার স্টাইলে মজা পেয়ে ওর বন্ধুরা সব হো হো করে হেসে উঠলো। মিতুর ইচ্ছে করছিলো ওখান থেকে ছুটে পালাতে। কিন্তু নিলয়ের ভয়ে সে ওঠারও সাহস পাচ্ছিলো না। নিলয় বললো, "এবার চা খাও। সিঙ্গারাও খাও।" মিতু মাথা নেড়ে জানালো সে খাবে না। নিলয় হঠাৎ দয়ালু হয়ে বললো, "আচ্ছা না খেলে এবার যেতে পারো।"

(৭)

মিতু আজ ক্লাসে কিছুতেই মন বসাতে পারছে না। সে বুঝে গিয়েছে এই মাসেই নিলয় কিছু একটা করে ফেলবে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার কী করণীয় সে বুঝে উঠতে পারছে না। একবার ভাবছে আত্মহত্যা করে এ মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি নেবে, কিন্ত মা আর ছোট ভাইটির কথা ভাবলে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠছে। আবার ভাবছে পাড়ার মুরুব্বীদের বলে নিলয়ের নামে একটা সালিশ বসাবে। কিন্তু এরপর যে নিলয় ভয়ংকর প্রতিশোধটা নেবে তা ভাবতেই আবার পিছিয়ে যাচ্ছে। একবার ভাবনা আসে পুলিশকে সব জানাবে, কিন্তু প্রভাবশালী বাবা মুহূর্তেই পুলিশকে ম্যানেজ করে নিলয়কে ছাড়িয়ে আনবে। এরপর নিলয়ের হাত থেকে কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না। সব ভাবনা জট পাকিয়ে তার মাথাটাকে এলোমেলো করে দেয়। পরমুহূর্তে একটা ভয়ংকর ভাবনা তার মাথায় আসে। ব্লেড দিয়ে কেটে নিজের মুখটাকেই নষ্ট করে দেবে। তাহলে অন্তত নিলয় তার দিকে আর তাকাবে না। কিন্তু মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তার নিজের চেহারা এবং নামকে। তাই এ দুটোর বিকৃতি কোনো মানুষই মেনে নিতে পারে না। ব্লেডে ক্ষতবিক্ষত নিজের ভয়ানক মুখশ্রীর কথা ভেবে পরমুহূর্তে সে ভাবনা থেকে পিছিয়ে আসে। তারপর হঠাৎ করেই মিতু আনমনা হয়ে যায়। মনে হয় এতো কিছু না করে নিলয়কে বিয়ে করে ফেললে কি খুব ভুল করা হবে? এমন করে যখন নিলয় ওকে চাইছে হয়তো বিয়ের পর নিলয় নিজেকে পাল্টে ফেলবে। ওকে হয়তো অনেক অনেক ভালোবাসা দিয়ে চিরসুখী করবে। এমন তো অহরহ হয়। বিয়ের পর অনেক সন্ত্রাসী পাল্টে গিয়ে একেবারে ভালোমানুষ বনে যায়। স্যারের একটা কথাও আজ তার কানে ঢোকে না। ক্লাস শেষে হনহন করে সে রওয়ানা দেয় স্টেশনের দিকে। আর পারবে না সে এমন করে প্রতিনিয়ত খুন হতে। খুন যদি হতেই হয় একেবারেই হবে। আজকেই একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে তার। শাটল ট্রেনে বসে মিতু বার বার আনমনা হয়ে যায়। বান্ধবীরা বার বার জানতে চায় কী হয়েছে? কিন্তু মিতু কারো সাথে কিছু শেয়ার করে না। কারণ সে জানে তার বান্ধবীরা তার এ সিদ্ধান্ত কিছুতেই মেনে নেবে না।
বাসায় ফিরে মাকে কিছু সে বলে না। ছোট ভাইয়ের সাথে অনেকদিন পর আজ সে খুনসুটি করে। মায়ের কোলে শুয়ে অনেক পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে। বাবার কথা মনে করে মা কাঁদেন। কিন্তু অন্যদিন মায়ের অশ্রু তার চোখ ভাসিয়ে দিলেও আজ কেন যেন তার কান্না আসে না। কেমন একটা অনুভুতি তাকে নিষ্পৃহ করে রাখে। আর বার বার অপেক্ষা করতে থাকে একটা কলিংবেলের। কিন্তু সেদিন আর মিতুদের ঘরে কলিংবেল বাজে না। পরের দিন মিতু আর ভার্সিটি যায় না। সে যেন কারো জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু সেদিনও মিতুদের বাসায় কেউ আসে না। পরদিন সে আবার ক্যাম্পাসে যায়। কিন্তু আজ কোথাও নিলয়কে দেখা যায় না। মিতু ভাবনায় পড়ে। বাসাতেও গেলো না, এখানেও নেই, তবে নিলয় কি তাকে মুক্তি দিয়েছে? নাকি নতুন কোনো কৌশল আঁটছে বন্ধুরা মিলে মিতুকে জব্দ করার। কেমন যেন অস্থিরতা পেয়ে বসে মিতুকে। গত তিন বছরে তো নিলয় তাকে একটা দিনের জন্য দৃষ্টির বাইরে রাখেনি। তাহলে গত তিনদিন সে এতো চুপচাপ আছে কেন? কোনো রকমে ক্লাস শেষ করে বাসায় এসে জানতে চায় কেউ এসেছিলো কিনা
কিন্তু না! এখানেও আসেনি। তবে নিলয় গেলো কোথায়? হঠাৎ তার মনে হয় সে নিলয়কে নিয়ে সকাল থেকে এতো ভাবছে কেন? তাহলে কি তার অজান্তে নিলয় তার জীবনে একটা জায়গা করে নিয়েছে? না না এটা হতেই পারে না। সে কখনোই নিলয়কে ভালোবাসেনি, বরং ভয় পেয়েছে, ঘৃণা করেছে। তাহলে আজ সকাল থেকে কেন সে নিলয়কে খুঁজে বেড়াচ্ছে!
হঠাৎ তীক্ষ্ণ কলিংবেলের শব্দে মিতু ভীষণভাবে চমকে ওঠে। ড্রইংরুমে উঁকি দিতেই তার বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটার শব্দ হয়। নিলয়, তার মা, এবং মামা এসেছে। মিতুর মা ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েন। তাঁর মনে পড়ে এই বাসাতেই তিনি বলেছিলেন মেয়ে আরেকটু বড় হোক, তখন না হয় দেখা যাবে। কিন্তু উনাদের মিষ্টি আনার বহর দেখে মিতুর মা প্রমাদ গুনেন। ভেতরে এসে মিতুর মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু মিতু আজ স্থির। মা জিজ্ঞেস করেন, "আজ কী বলে ওদের ফেরাবো?
" মিষ্টি আনার বহর দেখে তো মনে হচ্ছে আজই উনারা কথা ফাইনাল করে যাবেন। মিতুর চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার মা ভাইয়ের রক্তাক্ত দেহ। কারণ এবার রাজী না হলে তেমন পরিণতি হবে বলে নিলয় দুটো ছেলের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছিল। আবার ভেসে ওঠে তাকে জোর করে তুলে নিয়ে বিয়ে পড়ানোর দৃশ্য। সবকিছু হচ্ছে তাকে নিয়ে। এর একটাও যদি হয় তাহলে তার নাম কলঙ্কের সাথে উচ্চারিত হবে সমাজে। সবাই বলবে এই একটা মেয়ে পরিবারটাকে তছনছ করে দিলো। সে তার পরিবারকে খুব ভালোবাসে। তার সেক্রিফাইসের বদলে যদি তার মা ভাই ভালো থাকে তবে সে রাজী এ বিয়েতে।

(৮)

হঠাৎ করেই এই রুমে চলে আসেন নিলয়ের মা। স্মিত হেসে বলেন, "কী কথা হচ্ছে মা মেয়ের মধ্যে? চলো মিতু, ওই রুমে চলো। আমার ভাই তোমাকে দেখবে।" মিতু মাথা নিচু করে ওই রুমে গিয়ে বসে। নিলয়ের মামা কথা তোলেন, বলেন, "আসলে নতুন করে তো বলার কিছু নেই। কথা তো আপনাদের মধ্যে আগেই হয়ে আছে। আমি এসেছি শুধু তারিখটা ঠিক করতে। আর আপনাদের যদি কাউকে ডাকতে ইচ্ছে হয় তবে ডাকতে পারেন।" মিতুর মা আড় চোখে মিতুর দিকে তাকায়। কিন্তু মেয়েটি একদম শান্ত হয়ে বসে আছে। কোনো অস্থিরতা নেই তার মধ্যে আজ। মনের মধ্যে কেমন একটা ধাক্কা খায় তাঁর। কি এমন ঘটেছে মিতু সব ভয় কাটিয়ে এই বিয়ের ব্যাপারে কোনো আপত্তি করছে না। একটু ভেবে নিয়ে তিনি বলেন, "আসলে আমরা তো জানতাম না আপনারা আজ আসবেন। আমাদের আত্মীয়-স্বজন কাউকে তো আমরা কিছু জানাইনি এখন আমার ছেলেকে পাঠিয়ে আমার ভাইকে একটু ডেকে আনি। উনার সাথেই আপনারা কথা বলেন।" নিলয়ের মা সাথে সাথে বলেন, "হ্যাঁ, ডেকে পাঠান উনাকে। উনার বাসা তো কাছেই।" মিতুর ভাইকে পাঠানো হয়। এর মধ্যে মিতুকে নিয়ে মিতুর মা নাস্তার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এর মধ্যে কিন্তু নিলয় একটি কথাও বলেনি। খুবই নির্বিকার ভাবে সে বসে আছে। যেন তাদের এই বিয়েতে তার কোনো ভূমিকা নেই। মুরুব্বীরাই এর আয়োজক। কিছুক্ষণ পর হন্তদন্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করেন মিতুর মামা। এসেই উনাদের সাথে কোনো কথা না বলে সোজা রান্নাঘরে ঢুকে পড়েন। তারপর বেশ উঁচুস্বরেই বলেন, "এসব কী শুনছি? তোদের কি মাথা খারাপ হয়েছে? নিলয়ের মতো একটা বাজে ছেলের সাথে কী করে তুই মেয়ে বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবিস?" মিতুর মা ইশারায় গলার স্বর ছোট করতে বলেন। কিন্তু এতে উনি আরও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। বলেন, "মেয়েকে কেটে ভাসিয়ে দে। তারপরও ওর মতো একটা সন্ত্রাসীকে বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবিস না। মিতুর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। কারণ মামার পেছনেই এসে দাঁড়িয়েছে নিলয়ের মা। মিতুর মাও বিব্রত হয়ে পড়েন ভাইয়ের আচরণে। নিলয়ের মা মিতুর মামার দিকে তাকিয়ে বলেন, "আপনি কাকে সন্ত্রাসী বললেন?" মিতুর মামা বেশ রাগত স্বরে বলেন, "আমি বলবো কেন? পাড়ার সবাই জানে আপনার ছেলের ইতিহাস।" নিলয়ের মা গর্জে ওঠেন, "মুখ সামলে কথা বলবেন। আমার পরিবার মিতুর মতো মেয়েকে ঘরে নেয় না। শুধু ছেলে জানিয়ে দিয়েছে মিতুকে ছাড়া তার বাঁচা অসম্ভব। তাই আমি এসেছি।"
মিতুর মামাও দমার পাত্র নন। দুজনের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের মধ্যে ওখানে এসে উপস্থিত হয় নিলয়, তার মামা ও মিতুর ছোট ভাইটি। মিতুর মনে হয় সে আর টাল সামলাতে পারছে না। যে কোনো মুহূর্তে সে জ্ঞান হারাবে। কারণ এর পরিণতি কতটা ভয়ংকর হবে মামার জানা নেই। কিন্তু মিতুর জানা আছে। সে আতংকিত হয়ে নিলয়ের দিকে তাকায়। নিলয়ের চোখে সেই আগুন। মিতুর মামার দিকে তার চোখ। নিলয়ের মা নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, "এভাবে আমাকে অপমান করাতে তুই আমাকে আর তোর মামাকে এখানে এনেছিলি? এরপরও তুই এ মেয়েকে বিয়ে করতে চাস?" নিলয় তাকায় মিতুর দিকে। চোখ দপদপ করে জ্বলছে, মুখে ক্রুর হাসি। এর মাশুল মিতুকে কড়ায় গণ্ডায় দিতে হবে।
মিতুর মা অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি কল্পনাও করতে পারেননি এমন একটা ঘটনা তাঁর বাসায় ঘটে যাবে। তিনি নিলয়ের মায়ের হাত ধরে বলেন, "আপনারা ভুল বুঝবেন না। বসেন, নাস্তা খান। কথা এখনো শেষ হয়নি।" নিলয়ের মা বলেন, "আমার পক্ষে এখানে আর থাকা সম্ভব নয়। চল নিলয়।" নিলয়ের চোখ মিতুর দিকে। নিলয়ের এই চোখ মিতু চেনে। এরপর মিতুর কী করবে নিলয় সেটা মামার কল্পনাতেও নেই। তাই মিতুকেই নিতে হবে তার মা ভাইয়ের বেঁচে থাকার দায়িত্ব। সে সামনে এগিয়ে যায়, বলে, "মামা আমি তো বিয়েতে রাজী। তুমি এতো কথা কেন বলছো?  আমার ভালো আমি বুঝবো।"
মুহূর্তে পিনপতন নীরবতা ঘর জুড়ে। মামা স্তম্ভিত, মা হতবাক। নিলয়ের মা আর মামাও হতচকিত। নিলয়ের চোখের আগুন নিভে আসে। মামা অপমানে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় অভিশম্পাত করে যান ভাগনীকে, "একটা সন্ত্রাসীর জন্য তুই আজ আমাকে যে অপমান করলি সারাজীবন তিলতিল করে মরে এর ফল ভোগ করবি।
" মিতুর মা ভাইকে শান্ত করতে চেয়ে ব্যর্থ হন। মামা বেরিয়ে গেলে দায়সারা ভাবে বিয়ের তারিখ পাকা হয়। মিতু যখন রাজী তখন মিতুর মায়েরও তেমন আপত্তি নেই। অল্পবয়সে অনেক ছেলে নষ্ট হয়ে যায়। বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে মিতুকে পেয়ে, এ ভাবনা তাঁকে প্রলুব্ধ করে। তাছাড়া এমন প্রভাবশালী পরিবারে মেয়েটা ভালোই থাকবে।
এরপর মিতুর বিয়েটা হয়েই যায়। তবে যেমনটা জাঁকজমক হওয়ার কথা ছিল তেমনটা হয় না। মিতুর বান্ধবীরা বিয়েতে এসে মিতুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। কারণ বাইরের সবাই এটাকে প্রেমের বিয়ে হিসেবে জানলেও ওরা তো জানে মিতু কখনোই নিলয়কে ভালোবাসেনি।
মিতুর পক্ষের আত্মীয়রা তেমন একটা কেউ আসে না। মিতুর মতো একটা মেয়ের এমন ছেলে পছন্দ করা কেউ মেনে নিতে পারে না। নিলয়ের মাও আগের মতো আর আগ্রহ দেখাননি মিতুকে নিয়ে। ছেলেকে তিনি খুব ভালোবাসেন। তাই ছেলের জন্যই এ বিয়ে মেনে নিতে হয়।


* *
* * * * *


আজ মিতুর বাসর রাত। মিতু প্রতীক্ষা করছে নিলয়ের জন্য। মনকে সে স্থির করে ফেলেছে নিলয়কে নিয়ে সে পরম সুখী হবে। তার ভালোবাসা দিয়ে সে নিলয়কে সে ভালো করে তুলবে। আজ থেকে তার আর কোনো আলাদা স্বত্বা থাকবে না। ও আর নিলয় মিলে একটা স্বত্বায় পরিণত হবে। অনেকক্ষণ পর রুমে আসে নিলয়। মিতু মাথা নিচু করে থাকে। নিলয় এসে পাশে বসে। তারপর বলে, "আমার দিকে তাকাও।"

মিতু লজ্জায় তাকাতে পারে না। নিলয় হুকুমের স্বরে বলে, "তাকাও।" মিতু চমকে ওঠে, তাকায় নিলয়ের দিকে। নিলয়ের চোখ দপদপ করে জ্বলছে। বলে, "আমাকে যেভাবে প্রতিনিয়ত জ্বালিয়েছো, আমাকে যেভাবে সবার কাছে ছোট করেছো, তার চেয়ে হাজার গুণ আমি জ্বালাবো তোমায়, তার চেয়ে হাজার আমি ছোট করবো তোমায়।"
মিতুর চোখে শূন্য দৃষ্টি। তার কানে শোঁ শোঁ শব্দ। এ কী ঘটছে তার জীবনে? নিলয় উঠে দাঁড়ায়, তারপর সমস্ত আক্রোশ কণ্ঠে ঢেলে দিয়ে বলে, "আজ থেকে তোমার জ্বলা শুরু।"
এরপরের ইতিহাস মিতুর ক্ষয়ে যাওয়ার ইতিহাস। এরপরের ইতিহাস মিতুর একটু একটু করে নিঃশ্বেষ হওয়ার ইতিহাস।


সমাপ্ত

Search anything from this blog ;)